দিদার স্মৃতিতে এইএমএসের দ্বারে হবু চিকিৎসক
সুকন্যা পাল, দুর্গাপুর
চোখের সামনেই কি নিদারুণ কষ্টেই না দিদা মারা গেছেন। চরম অর্থাভাবে। প্রায় বিনা চিকিৎসায়। আসলে আর্থিক অস্বচ্ছলতা মানুষকে অনেকটাই পঙ্গু করে দেয়। প্রাণেও মেরে দেয়। দিদার এই চলে যাওয়াটাও অনেকটা তারই স্মৃতি অসহায়তার দৃষ্টান্ত বলা চলে।
শুধুই কি তাই, এযাবৎ যাঁদের অভাব অনটন নিত্য বারোমাস্যা, সেখানে গৃহিণী মাকে সংসারের হাড় ভাঙ্গা অবসরে কাগজের ঠোঙ্গা তো বানাতেই হবে। এবং তা হয়েছেও দিনের পর দিন। দুমুঠো অন্ন কোনক্রমে জোটানোর তাগিদে। কথায় আছে না, দুঃসময় একা আসে না। করোনার সৌজন্যে শুরু হল দীর্ঘ মেয়াদী লকডাউন। ব্যাস, বেসরকারি কারখানায় নামকে বাঁচতে স্বল্প বেতনের বাবা চাকরিতেও পড়লো দুর্ভাগ্যের কোপ। অগত্যা কিইবা করার। রান্নার গ্যাস ওভেন মেরামতির কাজেই বাবা দেওয়ালে পীঠ ঠেকিয়ে লড়াই করে চলেছেন এযাবৎ পেট ভড়ানোর দায়ে। দাদাকেও পড়াশোনার ময়দান থেকে অচিরেই বিদায় নিতে হয় নিতান্ত বাধ্যবাধকতার অসহনীয় দারিদ্রের নিষ্ঠুর কারণে।
তবে একটাই সান্ত্বনার প্রবাদবাক্য কিন্তু গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে আজও শোনা যায়। লক্ষ্মী ও সরস্বতী একত্রে নাকি এক ঘরে বাস করেন না। ঠিকই আছে, লক্ষ্মী নাইবা অধিষ্ঠাত্রী হলেন নিত্যানন্দ রজকের হতদরিদ্র আবাসে। কিন্তু সাম্প্রতিক সরস্বতীর বন্দনায় তো মুখর হয়ে উঠেছে তাঁর এই স্বপ্নের নিকেতন আচমকা পরমানন্দের চঞ্চলতায়।
আরে, নিত্যানন্দ রজকই বা কে? আর এই দারিদ্রের কুঠিরে সরস্বতী বন্দনারাই বা কি এমন ঘটলো শুনি? ধীরে ধীরে। খোলসা করে খুলে বলি তবে। পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরের সগরভাঙ্গা লাগোয়া দেশবন্ধুনগরে তাঁর বাস সপরিবারে। এমনই এক প্রান্তিক অঞ্চলের রান্নার গ্যাস ওভেনের ছাপোষা ঘরমুখো কারিগড় হলেন এই নিত্যানন্দবাবু। তাঁর এবং সাংসারিক অবসরে ঠোঁঙ্গা বানানোর জীবন সঙ্গিনী মীনাদেবীর আদুরে বাইশ বছরের মেয়ের নাম যে সরস্বতী। না না, স্রেফ নামে সে সরস্বতী নয়, কামেও যে সে সাক্ষাৎ সরস্বতী। তা কেমন?
সরস্বতী ছোট থেকেই মেধাবী ছাত্রী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। সংসারে সঙ্গতি কই যে ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পড়বে? অগত্যা পাড়ার বাংলা মাধ্যম স্কুল থেকে একের পর এক পরীক্ষা পাশ করা। রানীগঞ্জের টিডিবি কলেজ থেকে বোটানি অনার্স নিয়ে স্নাতক উত্তোরণ। এরই মধ্যে গত বছর নিটের পরীক্ষায় বসা। রায়পুর মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সুযোগও ঘটল। কিন্তু ভর্তি হতে প্রয়োজন বারো লক্ষ টাকা। গরীব কন্যার যা হয়। অত টাকা পাবে কোথায়? তাই লক্ষ্মীহীন সরস্বতীর এযাত্রায় সেই তথাকথিত স্বপ্নভঙ্গ। কিন্তু যে মেধায় সরস্বতী তাকে রোধে কার সাধ্য। কোনি ফাইট কোনি ফাইট এই অর্জূণের পাখির চোখে সরস্বতী যে আরও গভীরতায় জড়িয়ে পড়ল অধ্যায়ন প্রস্তুতির ডুবসাগরে। অবশেষে মিলল সেই আকাঙ্খিত অমৃতভান্ড। চলতি বছরের নিটে এবার সে ফিরে এলো সাফল্যের পালক মাথায় নিয়ে। ৫৬২ নম্বর পেয়ে ক্রমতালিকায় ছয় হাজারের স্থান কব্জা করে। দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সের (এইএমস) দরজা গেল খুলে। ডাক্তারিতে পড়ার জন্য। শুধুই কি তাই? ভর্তির কারণে এইএমএসের অনলাইন মৌখিক পরীক্ষায় সরস্বতী হাসিল করে নেয় এক্কেবারে প্রথম স্থান। বিনিময়ে চিচিং ফাঁকের মতোই সুযোগ মিলল সেখানে বিনামূল্যে পড়ার।
দুর্গাপুরের অচেনা হতদরিদ্র কুঠির থেকে তাই আজ ভারতের রাজধানীর এইএমএসের প্রবেশ দ্বারের উদ্দেশ্য ট্রেনে রওনা দিয়েছে একালের আরও এক হার না মানা সরস্বতী। তবুও প্রশ্নের খোঁচাটা মেরেই দিলাম। চিকিৎসা হলে কার সেবা করবে, দুস্থ মানুষের নাকি প্রতিষ্ঠিত ওষুধ প্রস্তুতকারীর? তার জবাবটা কিন্তু ছিল বেশ দীপ্ত, আমার দিদা কিন্তু মারা যায় অর্থের অভাবে, চিকিৎসা না পেয়ে। কোনও ওষুধ কোম্পানি সেদিন এগিয়ে আসেনি। আমি সেই দিদার আপন নাতনি। তাই দুস্থদের সেবাই আমার সঙ্কল্প।
সরস্বতীর ট্রেন যে ছুটছে আর ছুটছে লালকেল্লা শহরের অভিযাত্রায়। একেকটা মাইলস্টোন পেড়িয়ে পেড়িয়ে। জীবন স্টেশনের ও স্বপ্ন হল্টের। এ যেন দিদার স্মৃতির নক্সিকাঁথায় দুস্থ সেবার ঠাঁসবুনোটে হবু চিকিৎসকের কতকথা I